মহেশখালী যেন বাংলাদেশের হাম্বানটোটা না হয়

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক:সম্প্রতি আমাদের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বহুজাতিক সম্মেলনে বলেছেন চীন নাকি টাকার বস্তা বাংলাদেশকে দিতে চাচ্ছে। কথাটি শুনে গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে গ্রাম্য মহাজনদের কথা মনে হলো, যারা টাকা না চাইলেও টাকা, মানে ঋণ দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ঋণের বোঝা নিরীহ দরিদ্রজনদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে পরে ঋণগ্রহীতাদের জায়গা-জমি আত্মসাৎ করে নেয়। নিজেদের দারিদ্র্যের কারণে তারা মহাজনদের প্রস্তাবের লোভ সামলাতে না পেরে ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে ঋণ গ্রহণ করে নিজেদের গলায় বস্তুত ফাঁসির দড়ি জড়িয়ে দেয়। কবিগুরুর ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় এমন দৃষ্টান্তের উল্লেখ রয়েছে যেখানে দরিদ্র প্রজা উপেন বলছে, ‘শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবি গেছে ঋণে’। সাধারণ মানুষ যে অনেক সময় লোভের বশবর্তী হয়ে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা হারিয়ে ফেলে তা দেখা যাচ্ছে কয়েকটি প্রতারক অনলাইন ব্যবসায়ীর পাতা ফাঁদে নিরীহ মানুষের পা দেওয়ার ঘটনাগুলো থেকে। এসব প্রতিষ্ঠান যখন অর্ধেক বা তার চেয়েও কম মূল্যে দ্রব্যসামগ্রী বিক্রির প্রস্তাব দিল তখন অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষও চিন্তা করেনি যে প্রস্তাবকারী সংস্থা কীভাবে অর্ধেক মূল্যে দ্রব্য বিক্রি করবে! শুভবুদ্ধির প্রয়োগ না করে তারা নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছে। চীন গত কয়েক বছরে তাদের আর্থিক জগতে প্রাচুর্য এনে ঠিক গ্রাম্য মহাজনদের মতোই টাকার বস্তা নিয়ে নেমেছে দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রলোভন দেখিয়ে ঋণজালে জর্জরিত করে সেসব দেশের ভূমি নিজ দখলে নিতে। একটি দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোও ভবিষ্যতে উচ্চ সুদের ঋণ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতার কথা বিবেচনায় না এনে চীনা প্রস্তাবের লোভ ঠেকাতে না পেরে চীন যত দেয় ততই ঋণ গ্রহণ করে আজ চরম বিপদগ্রস্ত। এভাবে ঋণের ফাঁদে ফেলে চীন শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে ৯০ বছরের জন্য, যার জন্য আজ শ্রীলঙ্কা পস্তাচ্ছে। কিন্তু তাতে লাভ নেই। এ পস্তানোটা অনেক দেরিতে হয়ে গেছে। প্রবাদ আছে- ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’। শ্রীলঙ্কা যদি চীনের টাকার বোঝা দেখে লোভে না পড়ে বাস্তবপন্থি হয়ে সে টাকা প্রত্যাখ্যান করত তাহলে সে দেশটির এ দুর্দশা হতো না। শুধু শ্রীলঙ্কাই নয়, এমনি ঋণের ফাঁদে পড়ে নিজ দেশের ভূমি চীনের কাছে দিতে বাধ্য হয়েছে মালদ্বীপ ও চীনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু পাকিস্তানও। পাকিস্তান চরম বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থায় চীন থেকে লাগামহীন ঋণ গ্রহণ করে। চীনের ঋণের ফাঁদে নিক্ষিপ্ত হয়ে তাদের গোয়াদর বন্দর এলাকা চীনকে দিতে বাধ্য হয়, যার কারণে সে অঞ্চলে মারাত্মক ধরনের চীনবিরোধী উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, অনেক চীনা নাগরিককে আক্রমণ করেছে স্থানীয় লোকেরা, চীনা কনস্যুলেটেও আক্রমণ হয়েছে। এমনকি আফ্রিকার জিবুতিতেও চীন একইভাবে ঋণের জাল ফেলে ভূমি দখলে নিয়ে সেখানে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে।

 

এ কথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই যে চীন একটি আগ্রাসী দেশ। অন্য দেশের ভূমি সামরিকবলে, কৌশলে দখল করে আজ চীন এত বিরাট ভূখণ্ডের মালিক। চীন অতীতে যে ভূখণ্ডটি জোর করে দখলে নিয়েছিল, যা আজ জিনজিয়াং অঞ্চল নামে পরিচিত, যেখানে বসবাস করেন তুর্কি বংশোদ্ভূত উইঘুর মুসলমান জনগোষ্ঠী, যারা চীনের দ্বারা অমানবিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। এরা বহু বছর ধরেই স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে আসছে। এ ছাড়া ১৯৫০ সালে চীন সামরিক বলপ্রয়োগে তিব্বত দখল করে নিয়েছে।

 

ঐতিহাসিকভাবে তিব্বত কখনো চীনের অংশ ছিল না, তিব্বতিরা চীনের কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত নয়, যদিও সময় সময় চীন এ অঞ্চল দখলে নিয়েছিল। একসময় তিব্বত ছিল চীনের কুইং রাজের আশ্রিত রাজ্য, চীনের অংশ নয়। আন্তর্জাতিক আইনে উপনিবেশ ও আশ্রিত রাজ্যের মর্যাদা আলাদা। ১৯১২ সালে কুইং রাজ শেষ হলে চুক্তি অনুযায়ী কুইংদের সব এলাকা চীনের সার্বভৌমত্বে চলে যায়। কিন্তু চীনের নতুন সরকার তিব্বতের ওপর তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেনি। তিব্বত অতীতে তাদের ধর্মগুরু দালাই লামার শাসনাধীন ছিল, কুইং রাজবংশের পতনের পর দালাই লামা সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে উল্লেখ করেন, তিব্বত আর চীনের আশ্রিত রাজ্য নয়। সে সময় তিব্বত মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে উভয় দেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। সে মোতাবেক চীন আন্তর্জাতিক আইনে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়। ১৯২০ সালেও চীনের কুইং রাজবংশ সামরিক বলপ্রয়োগ করেই তিব্বতকে চীনের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করেছিল জুংগার খানাটকে উচ্ছেদ করে, যুক্তরাজ্য যেমন বহু অঞ্চলকে উপনিবেশ না করে আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করেছিল।

১৯১১-১২ সালে তিব্বত সেনাবাহিনী তিব্বতে অবস্থানরত কুইং গেরিসনে আক্রমণ চালায়। এরপর ১৯১২ সালে কুইং রাজবংশ তিব্বতের সঙ্গে চুক্তি করে তিব্বতের কেন্দ্রীয় এলাকা পরিত্যাগ করে। কুইং রাজবংশকে পরাস্ত করে চীনের নতুন সরকার তিব্বতের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টার অংশ হিসেবে দালাই লামাকে তাঁর পদবি অক্ষুণ্ন রেখে তিব্বতের ওপর আধিপত্য রক্ষার কথা বললে দালাই লামা পরিষ্কার বলে দেন তিনি তিব্বতের স্বাধীনতা ম্লান হতে দেবেন না। ১৯১৩ সালে সিমলায় ব্রিটিশ, চীন ও তিব্বতের মধ্যে এক ত্রিপক্ষীয় সম্মেলন হয়, যাতে তিব্বত সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবেই যোগ দেয়। এ চুক্তিও ব্রিটিশ ও চীন কর্তৃক তিব্বতের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির প্রমাণ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, তিব্বত কখনো চীনের অংশ ছিল না। এমনকি চীনের উপনিবেশও ছিল না। বেশ কিছু সময় তিব্বত চীনের আশ্রিত রাজ্য ছিল তবে উপনিবেশ নয়। আন্তর্জাতিক আইনে উপনিবেশ এবং আশ্রিত রাজ্যের মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে। ছয় শতক থেকে, যখন অঞ্চলটিতে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে, সে সময় ঝিংঝংয়ের ইয়ারলুং রাজবংশের শাসনে তিব্বত সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। সপ্তম শতকে তিব্বত চীন দেশে দূতও পাঠিয়েছিল। নবম শতকে তিব্বত সাম্রাজ্য বেশ শক্তিশালী ছিল, যা তখন তিব্বত মালভূমির বাইরেও এর ক্ষমতা প্রসারিত করেছিল। এমনকি বাংলার পাল রাজ্যেও এর প্রভাব ছিল, দাবি করা হয় রাজা ধর্মপালও তিব্বতের বশ্যতা মেনে নিয়েছিলেন। পরে তিব্বত বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত হলে এর শক্তি কমে যায়। ১২ শতকে তিব্বতের দূত চেঙ্গিস খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে চেঙ্গিস খান তাদের আটক করেন। চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর অল্প আগে মোঙ্গলরা তিব্বতের কিছু অংশ আক্রমণ করে। ১২৪০ সালে মোঙ্গলরা তিব্বত দখলে নেয় ১২৪১ সালে উখেদাই খানের মৃত্যুর পর মোঙ্গল শাসকরা মঙ্গোলিয়ায় ফিরে গেলে তিব্বত আবার স্বাধীনতা পায়। তবে ১২৪৪ সালে মোঙ্গলরা পুনরায় তিব্বত আক্রমণ করে এবং ১২৪৯ সালে পুরো তিব্বত দখলে নেয়। মোঙ্গল ইউয়ান রাজবংশ তখন চীনে তাদের শাসন প্রসারিত করলেও মোঙ্গলরা তিব্বতকে ভিন্নভাবে শাসন করত। তিব্বতে মোঙ্গল আধিপত্য ছিল পরোক্ষ, কেননা ধর্মগুরু সাক্য লামাই ছিলেন ক্ষমতার উৎস। ১২৬০ সালে চেঙ্গিসের বংশধর কুবলাই খান তিব্বতের এক বৌদ্ধ গুরুকে তাঁর ধর্মশিক্ষকরূপে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ইউয়ান রাজবংশের পতনের পর ১৪ থেকে ১৭ শতক পর্যন্ত দালাই লামারা তিব্বতের মূল শাসকে রূপান্তরিত হন। পরবর্তী ৪০০ বছর তিব্বত দালাই লামাদের শাসনে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। ১৬৫২ সালে পঞ্চম দালাই লামা চীনের কুইং রাজার দরবারে গমন করলে কুইং রাজা তাকে একটি রাজকীয় সিলমোহর প্রদান করেন। ১৭ শতকে স্বাধীন তিব্বত লাদাখও আক্রমণ করেছিল। ১৭২০ সালে চীনের কুইং রাজারা তিব্বত দখল করেছিলেন, যা ১৯১২ সালে কুইং রাজবংশের পতনের আগ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এমনকি কুইং রাজারাও প্রত্যক্ষভাবে তিব্বত শাসন করতেন না, বরং তিব্বতে ‘আমবান’ নামক একটি রাজপ্রতিনিধির দফতর প্রতিষ্ঠা করে তিব্বত নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং ক্ষমতা মূলত দালাই লামাদের হাতেই থাকত, যারা কুইং রাজাদের সমর্থনপুষ্ট ছিলেন। ২০ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ ও রাশিয়া তিব্বতের ওপর নিজ নিজ প্রভুত্ব স্থাপনের চেষ্টায় প্রতিযোগিতায় নামলে ব্রিটিশ কর্নেল ফ্রান্সিস ইয়াং হাসবেন্ড তিব্বতে অভিযান চালিয়ে তিব্বতকে ব্রিটিশপন্থি এক বাণিজ্য চুক্তিতে বাধ্য করেন। তখন চীনের কুইং রাজাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন তারা তিব্বতের সার্বভৌমত্বের মালিক এবং এটিই ছিল তিব্বতের সার্বভৌমত্বের ওপর প্রথম চীনা দাবি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সেনারা লাসা আক্রমণ করলে ১৩তম দালাই লামা মঙ্গোলিয়ায় এবং পরে বেইজিংয়ে পালিয়ে যান ১৯০৮ সালে। ১৯০৪ সালে ব্রিটিশ-তিব্বত চুক্তির পর ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ-চীন চুক্তি হয়। ১৯০৭ সালে ব্রিটিশ ও রাশিয়া মেনে নেয় যে তারা চীনের মধ্যস্থতা ছাড়া তিব্বতের সঙ্গে কোনো আলোচনায় যাবে না। এসব চুক্তি প্রমাণ করে তিব্বত সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। ১৯০৮ সালে চীনের কুইং সরকার তিব্বতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সেনা কমান্ডার নিযুক্ত করে। দালাই লামা ভারতে পালিয়ে যান। ১৯১১ সালে চীনে কুইং রাজ্যের পতনের পর কুইং রাজের সব সেনা তিব্বত ছেড়ে চলে যায়। ১৯১২ সালে দালাই লামা তিব্বতে ফেরেন এবং কুইংয়ের রাজপ্রতিনিধি আমবান ও সব চীনা সেনা বহিষ্কার করেন। ১৯১৩ সালে দালাই লামা এ মর্মে ফরমান জারি করেন যে চীন ও তিব্বত কেউ কারও অধীন নয়। পরবর্তী ৩৬ বছর তিব্বত মূলত স্বাধীন দেশ হিসেবে বিরাজ করে, যদিও ১৯৩০ সালে চীন তিব্বতের ওপর দাবি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। ১৯১৩ সালের তিব্বত-মঙ্গোলিয়া চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে তিব্বতের স্বাধীনতার আর এক স্বীকৃতি। ১৯১৪ সালে তিব্বত সরকার ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার ফলে ব্রিটিশ-ভারত ও তিব্বতের সীমানা বিভক্তির জন্য ম্যাকমেহন লাইন টানা হয়। সে চুক্তিতে চীন সাক্ষী হিসেবে দস্তখত করেছিল, যা মোটামুটি তিব্বতের স্বাধীনতায় চীনা স্বীকৃতি। যদিও পরবর্তীতে চীনা বিপ্লবের পর চীন সিমলা চুক্তি ও ম্যাকমেহন লাইন অস্বীকার করে। ১৯৫০ সালে চীন তিব্বত দখল করে মূলত তার নগ্ন আগ্রাসন প্রমাণ করেছে। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের জনগণ চীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পর চীন তিব্বতিদের ওপর চরম নির্যাতন শুরু করে, এমনকি তাদের ফসল নষ্ট করে সেখানে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। চীন শুধু তিব্বতের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপরই খড়্গ চালায়নি, তিব্বতের শস্য হস্তগত করে, যার ফলে তিব্বতে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দেয়।

 

চীন কর্তৃক জিনজিয়াং দখলের ইতিহাস অনেক মর্মান্তিক, অমানবিক, বেদনাদায়ক এবং পাশবিক, যার নজির পৃথিবীতে বিরল। ১৮৮৪ সালে চীনের কুইং রাজা তুর্কি (আর্য) বংশীয় মুসলমান লোকদের আবাসভূমি দখল করেন, যার নাম ছিল জুনগারিয়া এবং টিয়ানশান। ১৮৬২ সালে সেই তুর্কি মুসলিম জনগোষ্ঠীর দ্বারা ডানগান বিদ্রোহের পর চীনা কর্তৃপক্ষ একে জিনজিয়াং নামে অধিষ্ঠিত করেন। অষ্টম শতকে তুর্কি বংশোদ্ভূত উইঘুর সম্প্রদায় সেখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম ধর্ম ছড়িয়ে দেয়। ১৩ শতকে এলাকাটি মোঙ্গল শাসনে ছিল। কিন্তু পরে আবার তুরস্ক বংশীয়রা ক্ষমতা নেয়। ৭৪৪ সালে উইঘুরের সম্প্রদায়ের নয়টি উপসম্প্রদায় মিলিতভাবে একটি কনফেডারেশন গঠন করে। ৮০৮ সালে উইঘুররা তিব্বতের কিছু এলাকা দখলে নেয়। ১২০৬ সালে চেঙ্গিস খান মোঙ্গল এবং তুর্কি উপজাতিদের একত্রিত করে মোঙ্গল সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেন। ১২০৯ সালে টারকান নামক উইঘুর অঞ্চল মোঙ্গলদের বশ্যতা মেনে নিলে উইঘুর নেতাদের তাদের এলাকার নিয়ন্ত্রণ প্রদান করা হয়। ১২১৮ সালে চেঙ্গিস খান ‘কোয়ারা খিটাল’ নামক উইঘুর শাসনাধীন এলাকা দখল করেন। ১২৭১ সালে চেঙ্গিস বংশধর কুবলাই খান চীনা অঞ্চলে ইউয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও অরিম এলাকার নিয়ন্ত্রণ মোঙ্গল রাজা ‘আরিক বোকের’ কাছে চলে যায়। ১৩৮৯ সালে খান মনসুর চাকতাই এবং তুঘলুগ তিমুর উইঘুর এলাকার বৌদ্ধধর্মাবলম্বী জনগণকে ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত করেন। ক্রমান্বয়ে এলাকাটি তুর্কি ভূমির মর্যাদা লাভ করে, যার নাম হয় ‘মুঘলিস্তান’। এভাবে ১০০ বছর রাজত্বের পর এলাকাটি দুই ভাগে ভাগ হয়, যার মধ্যে ইয়াকান্দ এলাকার রাজত্ব নেন মির্জা আবু বকর। উইঘুুর বংশীয় জুনগার শাসকদের সময় চীনের মহাপ্রাচীর এলাকা থেকে পূর্ব কাজাখস্তান পর্যন্ত এবং উত্তর কাজাখস্তান থেকে দক্ষিণ সাইবেরিয়া পর্যন্ত উইঘুর শাসন বিস্তৃত ছিল। ১৭৬০ সালে চীনের কুইং রাজবংশের শাসক কুইয়ান লং চূড়ান্তভাবে জুনগারিয়ান মালভূমি এবং তারিম বেসিন দখল করে জিনজিয়াং অঞ্চলভুক্ত করেন, যার দক্ষিণ অংশ ছিল তুর্কি বংশীয় মুসলমানদের বাসভূমি। ১৭৫৫ সালে কুইং মাঞ্চু শাসক জুনগারদের রাজ্য দখল করে সেখানে গণহত্যা চালান। এ সময় তুর্কি বংশীয় মুসলমানরা তখন চীনের কুইং শাসকদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হন। ১৭৬৫ সালে এক উইঘুর মহিলাকে চীনের কর্মকর্তারা গণধর্ষণ করলে উইঘুরের মুসলমানরা বিদ্রোহ করেন। তখন চীনের মাঞ্চু সম্রাট উইঘুরের বিদ্রোহ এলাকায় গণহত্যা চালানোর নির্দেশ প্রদান করেন, সব উইঘুর শিশু ও মহিলাকে ক্রীতদাসে পরিণত করেন এবং উইঘুর পুরুষদের হত্যা করেন। চীনা সেনারা উইঘুর নারীদের গণধর্ষণ করলে উইঘুর সম্প্রদায় চীনা শাসনের বিরুদ্ধে খেপে ওঠে। কিন্তু চীনা সম্রাটের নির্দেশে উইঘুর বিদ্রোহের নেতাদের দেহ খণ্ড খণ্ড করে হত্যা করা হয়। এরূপ নির্মমতার সঙ্গে সে সময়ের চীনা সম্রাট তুর্কী বংশীয় উইঘুরদের বিশাল খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকা সামরিকবলে দখলে নেয়। পরবর্তীতে চীনে প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক সরকারও একইভাবে নির্যাতন চালাতে শুরু করে উইঘুরদের ওপর, যা এখন চলছে। ১৯৫৫ সালে অঞ্চলটিকে স্বায়ত্তশাসিত এলাকার মর্যাদা দেওয়া হয় বটে, কিন্তু সেটি নামমাত্র। চীন জিনজিয়ান প্রদেশকে স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা তো দেয়ইনি বরং সেখানে তুর্কি বংশীয় মুসলমানদের ওপর চালাচ্ছে গণহত্যাসহ অকথ্য নির্যাতন, সেই কুইং রাজাদের মতো। জিনজিয়ানে মুসলিম নারীদের ওপর অবাধ ধর্ষণ চালাচ্ছে চীনা সেনা, আইন প্রয়োগকারী এবং কর্মকর্তারা, যার জন্য বিশ্বের অনেক দেশই সোচ্চার হলেও পাকিস্তান, এমনকি তুরস্ক উইঘুর মুসলমানরা যাদের জাতভাই, তারাও নিশ্চুপ, চীনের টাকার বস্তার দিকে তাকিয়ে।

 

চীন যে ভূমি দখলের ব্যাপারে তার অতিঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও ছাড় দেয় না তার প্রমাণ পাকিস্তানে গোয়াদর উপকূলে পাকিস্তানি দ্বীপ দখল। চীন নেপালের ভূমি দখল করেছে বলে সম্প্রতি নেপাল সরকার অভিযোগ করেছে, অথচ নেপালের সঙ্গে চীন শুধু গভীর সখ্যই গড়েনি, নেপালে চীনা রাষ্ট্রদূত নির্লজ্জের মতো খোলাখুলিভাবে নেপালের রাজনীতি প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন, সফল হয়নি যদিও। সম্প্রতি চীন ভুটানের অভ্যন্তরেও প্রবেশ করেছে বলে ভুটান সরকার অভিযোগ করেছে। আর ভারতের ভূমিতে তো চীন প্রতিনিয়তই প্রবেশ করছে। আন্তর্জাতিক সমুদ্র কনভেনশনের বিধান ভঙ্গ করে দক্ষিণ সাগর, যা মহাসাগর বটে, সমুদ্র আইনের দৃষ্টিতে যা সব দেশের জন্য উন্মুক্ত, চীন সেই মহাসাগরকে নিজ দেশের একক সার্বভৌম অংশ দাবি করে বিশ্বযুদ্ধের পাঁয়তারা করছে, যার জন্য অস্ট্রেলিয়াসহ এ অঞ্চলের অন্য দেশ যথা জাপান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই প্রভৃতি দেশের সঙ্গে চীনের অনেকটাই যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, যার জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনা এবং কোয়াড মোর্চা গড়ে উঠেছে। আমাদের সৌভাগ্য চীনের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত নেই। থাকলে চীন আমাদের ভূমিও দখল করত। চীন একই নীলনকশা নিয়ে সিরিয়ায় অনুপ্রবেশের চেষ্টায় লিপ্ত বলে খবর পাওয়া গেছে।

 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় শুধু চীনের ঋণ দেওয়ার টাকার বস্তার কথাই বলেছেন, চীনের ঘুষের টাকার বস্তার কথা বলেননি। চীন যে আর একটি টাকার বস্তা রেখেছে বাংলাদেশে ঘুষবাণিজ্য প্রসারিত করার জন্য তা প্রমাণিত সত্য। কয়েক বছর আগে এক সিনিয়র সচিবকে মোটা অঙ্কের ঘুষ প্রদানের চেষ্টা করলে সেই দেশপ্রেমী সচিব সাহেব তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে জানিয়ে দিলে ঘুষ প্রদানকারী কোম্পানির একটি প্রজেক্ট বাদ করা হয়। চীন টাকা ছড়াচ্ছে বাংলাদেশে। যার কারণে তাদের পক্ষে কথা বলার লোকের অভাব নেই। এদের অনেকে আবার মজ্জাগত ভারতবিরোধী বিধায় চীনের প্রতি তাদের বন্দনা অপরিসীম শুধু ভারতবিরোধিতার কারণে। তাদের বদলানো কষ্টকর। কারণ তারা হয় চীনা টাকায় বুঁদ হয়ে আছে অথবা মজ্জাগত ভারতবিরোধী। চীন মহেশখালীর পাশে একটি দ্বীপকে তথাকথিত উন্নয়নের প্রস্তাব দিয়েছে এই শর্তে যে, দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকবে, অর্থাৎ তারা এটিকে বাংলাদেশের হাম্বানটোটায় পরিণত করে এটি তাদের দখলে নেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সম্প্রতি প্রজ্ঞাবান, কর্তব্যনিষ্ঠ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, জাতির বিবেক বলে স্বীকৃত গাফ্ফার ভাই এবং নির্ভয়ে সত্য, মেধা ও গবেষণা-ভিত্তিক, বস্তুনিষ্ঠ এবং জাতির জন্য মঙ্গলকর লেখার জন্য জনপ্রিয়তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সৈয়দ বোরহান কবীর তাঁদের সুচিন্তিত এবং গবেষণামূলক শক্ত লেখনী দ্বারা চীনের কুমতলবের কথা রাখঢাক না রেখেই ব্যক্ত করেছেন, যা দেখে দেশের মানুষ নিশ্চয়ই এর প্রতিবাদে সোচ্চার হলে, চীনের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা। আজ সদ্যপ্রয়াত পীর হাবিবুর রহমানের অনুপস্থিতি খুব অনুভব করছি, কারণ তাঁর ক্ষুরধার লেখনীও চীনের মতলব এবং বাংলাদেশে বসবাসরত সে দেশের পোষ্যদের চক্রান্ত উন্মোচনে সহায়ক হতো। তবে দেশের অন্য বহু বরেণ্য এবং মেধাসম্পন্ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তিমান লেখকরাও এ বিষয়ে তাঁদের কালি-কলম ব্যবহার করলে চীনা কুকীর্তির পরিকল্পনা অবশ্যই ভেস্তে যাবে।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» চিন্ময় কৃষ্ণকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে হস্তান্তর

» ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশার ৫ যাত্রী নিহত

» চশমার যত্ন

» বর্তমানে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেওয়ার কেউ নেই

» প্যানক্রিয়াটিক ডায়াবেটিস

» দেশের চার সমুদ্র বন্দরে সতর্ক সংকেত

» পরীক্ষামূলকভাবে বঙ্গবন্ধু রেলসেতুতে চলল ট্রেন

» কী কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন আমির!

» ব্যাটিং বিপর্যয়ে বড় হারের মুখে বাংলাদেশ

» গাজায় ইসরায়েলি হামলা চলছেই, বাড়ছে নিহতের সংখ্যা

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

মহেশখালী যেন বাংলাদেশের হাম্বানটোটা না হয়

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক:সম্প্রতি আমাদের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বহুজাতিক সম্মেলনে বলেছেন চীন নাকি টাকার বস্তা বাংলাদেশকে দিতে চাচ্ছে। কথাটি শুনে গভীর উৎকণ্ঠার সঙ্গে গ্রাম্য মহাজনদের কথা মনে হলো, যারা টাকা না চাইলেও টাকা, মানে ঋণ দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ঋণের বোঝা নিরীহ দরিদ্রজনদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে পরে ঋণগ্রহীতাদের জায়গা-জমি আত্মসাৎ করে নেয়। নিজেদের দারিদ্র্যের কারণে তারা মহাজনদের প্রস্তাবের লোভ সামলাতে না পেরে ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে ঋণ গ্রহণ করে নিজেদের গলায় বস্তুত ফাঁসির দড়ি জড়িয়ে দেয়। কবিগুরুর ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় এমন দৃষ্টান্তের উল্লেখ রয়েছে যেখানে দরিদ্র প্রজা উপেন বলছে, ‘শুধু বিঘে দুই ছিল মোর ভুঁই আর সবি গেছে ঋণে’। সাধারণ মানুষ যে অনেক সময় লোভের বশবর্তী হয়ে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা হারিয়ে ফেলে তা দেখা যাচ্ছে কয়েকটি প্রতারক অনলাইন ব্যবসায়ীর পাতা ফাঁদে নিরীহ মানুষের পা দেওয়ার ঘটনাগুলো থেকে। এসব প্রতিষ্ঠান যখন অর্ধেক বা তার চেয়েও কম মূল্যে দ্রব্যসামগ্রী বিক্রির প্রস্তাব দিল তখন অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষও চিন্তা করেনি যে প্রস্তাবকারী সংস্থা কীভাবে অর্ধেক মূল্যে দ্রব্য বিক্রি করবে! শুভবুদ্ধির প্রয়োগ না করে তারা নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছে। চীন গত কয়েক বছরে তাদের আর্থিক জগতে প্রাচুর্য এনে ঠিক গ্রাম্য মহাজনদের মতোই টাকার বস্তা নিয়ে নেমেছে দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রলোভন দেখিয়ে ঋণজালে জর্জরিত করে সেসব দেশের ভূমি নিজ দখলে নিতে। একটি দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোও ভবিষ্যতে উচ্চ সুদের ঋণ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতার কথা বিবেচনায় না এনে চীনা প্রস্তাবের লোভ ঠেকাতে না পেরে চীন যত দেয় ততই ঋণ গ্রহণ করে আজ চরম বিপদগ্রস্ত। এভাবে ঋণের ফাঁদে ফেলে চীন শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে ৯০ বছরের জন্য, যার জন্য আজ শ্রীলঙ্কা পস্তাচ্ছে। কিন্তু তাতে লাভ নেই। এ পস্তানোটা অনেক দেরিতে হয়ে গেছে। প্রবাদ আছে- ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’। শ্রীলঙ্কা যদি চীনের টাকার বোঝা দেখে লোভে না পড়ে বাস্তবপন্থি হয়ে সে টাকা প্রত্যাখ্যান করত তাহলে সে দেশটির এ দুর্দশা হতো না। শুধু শ্রীলঙ্কাই নয়, এমনি ঋণের ফাঁদে পড়ে নিজ দেশের ভূমি চীনের কাছে দিতে বাধ্য হয়েছে মালদ্বীপ ও চীনের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু পাকিস্তানও। পাকিস্তান চরম বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থায় চীন থেকে লাগামহীন ঋণ গ্রহণ করে। চীনের ঋণের ফাঁদে নিক্ষিপ্ত হয়ে তাদের গোয়াদর বন্দর এলাকা চীনকে দিতে বাধ্য হয়, যার কারণে সে অঞ্চলে মারাত্মক ধরনের চীনবিরোধী উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, অনেক চীনা নাগরিককে আক্রমণ করেছে স্থানীয় লোকেরা, চীনা কনস্যুলেটেও আক্রমণ হয়েছে। এমনকি আফ্রিকার জিবুতিতেও চীন একইভাবে ঋণের জাল ফেলে ভূমি দখলে নিয়ে সেখানে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে।

 

এ কথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই যে চীন একটি আগ্রাসী দেশ। অন্য দেশের ভূমি সামরিকবলে, কৌশলে দখল করে আজ চীন এত বিরাট ভূখণ্ডের মালিক। চীন অতীতে যে ভূখণ্ডটি জোর করে দখলে নিয়েছিল, যা আজ জিনজিয়াং অঞ্চল নামে পরিচিত, যেখানে বসবাস করেন তুর্কি বংশোদ্ভূত উইঘুর মুসলমান জনগোষ্ঠী, যারা চীনের দ্বারা অমানবিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। এরা বহু বছর ধরেই স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে আসছে। এ ছাড়া ১৯৫০ সালে চীন সামরিক বলপ্রয়োগে তিব্বত দখল করে নিয়েছে।

 

ঐতিহাসিকভাবে তিব্বত কখনো চীনের অংশ ছিল না, তিব্বতিরা চীনের কোনো সম্প্রদায়ভুক্ত নয়, যদিও সময় সময় চীন এ অঞ্চল দখলে নিয়েছিল। একসময় তিব্বত ছিল চীনের কুইং রাজের আশ্রিত রাজ্য, চীনের অংশ নয়। আন্তর্জাতিক আইনে উপনিবেশ ও আশ্রিত রাজ্যের মর্যাদা আলাদা। ১৯১২ সালে কুইং রাজ শেষ হলে চুক্তি অনুযায়ী কুইংদের সব এলাকা চীনের সার্বভৌমত্বে চলে যায়। কিন্তু চীনের নতুন সরকার তিব্বতের ওপর তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেনি। তিব্বত অতীতে তাদের ধর্মগুরু দালাই লামার শাসনাধীন ছিল, কুইং রাজবংশের পতনের পর দালাই লামা সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে উল্লেখ করেন, তিব্বত আর চীনের আশ্রিত রাজ্য নয়। সে সময় তিব্বত মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে উভয় দেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। সে মোতাবেক চীন আন্তর্জাতিক আইনে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়। ১৯২০ সালেও চীনের কুইং রাজবংশ সামরিক বলপ্রয়োগ করেই তিব্বতকে চীনের আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করেছিল জুংগার খানাটকে উচ্ছেদ করে, যুক্তরাজ্য যেমন বহু অঞ্চলকে উপনিবেশ না করে আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করেছিল।

১৯১১-১২ সালে তিব্বত সেনাবাহিনী তিব্বতে অবস্থানরত কুইং গেরিসনে আক্রমণ চালায়। এরপর ১৯১২ সালে কুইং রাজবংশ তিব্বতের সঙ্গে চুক্তি করে তিব্বতের কেন্দ্রীয় এলাকা পরিত্যাগ করে। কুইং রাজবংশকে পরাস্ত করে চীনের নতুন সরকার তিব্বতের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টার অংশ হিসেবে দালাই লামাকে তাঁর পদবি অক্ষুণ্ন রেখে তিব্বতের ওপর আধিপত্য রক্ষার কথা বললে দালাই লামা পরিষ্কার বলে দেন তিনি তিব্বতের স্বাধীনতা ম্লান হতে দেবেন না। ১৯১৩ সালে সিমলায় ব্রিটিশ, চীন ও তিব্বতের মধ্যে এক ত্রিপক্ষীয় সম্মেলন হয়, যাতে তিব্বত সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবেই যোগ দেয়। এ চুক্তিও ব্রিটিশ ও চীন কর্তৃক তিব্বতের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির প্রমাণ। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, তিব্বত কখনো চীনের অংশ ছিল না। এমনকি চীনের উপনিবেশও ছিল না। বেশ কিছু সময় তিব্বত চীনের আশ্রিত রাজ্য ছিল তবে উপনিবেশ নয়। আন্তর্জাতিক আইনে উপনিবেশ এবং আশ্রিত রাজ্যের মধ্যে পার্থক্যও রয়েছে। ছয় শতক থেকে, যখন অঞ্চলটিতে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে, সে সময় ঝিংঝংয়ের ইয়ারলুং রাজবংশের শাসনে তিব্বত সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। সপ্তম শতকে তিব্বত চীন দেশে দূতও পাঠিয়েছিল। নবম শতকে তিব্বত সাম্রাজ্য বেশ শক্তিশালী ছিল, যা তখন তিব্বত মালভূমির বাইরেও এর ক্ষমতা প্রসারিত করেছিল। এমনকি বাংলার পাল রাজ্যেও এর প্রভাব ছিল, দাবি করা হয় রাজা ধর্মপালও তিব্বতের বশ্যতা মেনে নিয়েছিলেন। পরে তিব্বত বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত হলে এর শক্তি কমে যায়। ১২ শতকে তিব্বতের দূত চেঙ্গিস খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে চেঙ্গিস খান তাদের আটক করেন। চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর অল্প আগে মোঙ্গলরা তিব্বতের কিছু অংশ আক্রমণ করে। ১২৪০ সালে মোঙ্গলরা তিব্বত দখলে নেয় ১২৪১ সালে উখেদাই খানের মৃত্যুর পর মোঙ্গল শাসকরা মঙ্গোলিয়ায় ফিরে গেলে তিব্বত আবার স্বাধীনতা পায়। তবে ১২৪৪ সালে মোঙ্গলরা পুনরায় তিব্বত আক্রমণ করে এবং ১২৪৯ সালে পুরো তিব্বত দখলে নেয়। মোঙ্গল ইউয়ান রাজবংশ তখন চীনে তাদের শাসন প্রসারিত করলেও মোঙ্গলরা তিব্বতকে ভিন্নভাবে শাসন করত। তিব্বতে মোঙ্গল আধিপত্য ছিল পরোক্ষ, কেননা ধর্মগুরু সাক্য লামাই ছিলেন ক্ষমতার উৎস। ১২৬০ সালে চেঙ্গিসের বংশধর কুবলাই খান তিব্বতের এক বৌদ্ধ গুরুকে তাঁর ধর্মশিক্ষকরূপে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ইউয়ান রাজবংশের পতনের পর ১৪ থেকে ১৭ শতক পর্যন্ত দালাই লামারা তিব্বতের মূল শাসকে রূপান্তরিত হন। পরবর্তী ৪০০ বছর তিব্বত দালাই লামাদের শাসনে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। ১৬৫২ সালে পঞ্চম দালাই লামা চীনের কুইং রাজার দরবারে গমন করলে কুইং রাজা তাকে একটি রাজকীয় সিলমোহর প্রদান করেন। ১৭ শতকে স্বাধীন তিব্বত লাদাখও আক্রমণ করেছিল। ১৭২০ সালে চীনের কুইং রাজারা তিব্বত দখল করেছিলেন, যা ১৯১২ সালে কুইং রাজবংশের পতনের আগ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এমনকি কুইং রাজারাও প্রত্যক্ষভাবে তিব্বত শাসন করতেন না, বরং তিব্বতে ‘আমবান’ নামক একটি রাজপ্রতিনিধির দফতর প্রতিষ্ঠা করে তিব্বত নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং ক্ষমতা মূলত দালাই লামাদের হাতেই থাকত, যারা কুইং রাজাদের সমর্থনপুষ্ট ছিলেন। ২০ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ ও রাশিয়া তিব্বতের ওপর নিজ নিজ প্রভুত্ব স্থাপনের চেষ্টায় প্রতিযোগিতায় নামলে ব্রিটিশ কর্নেল ফ্রান্সিস ইয়াং হাসবেন্ড তিব্বতে অভিযান চালিয়ে তিব্বতকে ব্রিটিশপন্থি এক বাণিজ্য চুক্তিতে বাধ্য করেন। তখন চীনের কুইং রাজাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন তারা তিব্বতের সার্বভৌমত্বের মালিক এবং এটিই ছিল তিব্বতের সার্বভৌমত্বের ওপর প্রথম চীনা দাবি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সেনারা লাসা আক্রমণ করলে ১৩তম দালাই লামা মঙ্গোলিয়ায় এবং পরে বেইজিংয়ে পালিয়ে যান ১৯০৮ সালে। ১৯০৪ সালে ব্রিটিশ-তিব্বত চুক্তির পর ১৯০৬ সালে ব্রিটিশ-চীন চুক্তি হয়। ১৯০৭ সালে ব্রিটিশ ও রাশিয়া মেনে নেয় যে তারা চীনের মধ্যস্থতা ছাড়া তিব্বতের সঙ্গে কোনো আলোচনায় যাবে না। এসব চুক্তি প্রমাণ করে তিব্বত সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। ১৯০৮ সালে চীনের কুইং সরকার তিব্বতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সেনা কমান্ডার নিযুক্ত করে। দালাই লামা ভারতে পালিয়ে যান। ১৯১১ সালে চীনে কুইং রাজ্যের পতনের পর কুইং রাজের সব সেনা তিব্বত ছেড়ে চলে যায়। ১৯১২ সালে দালাই লামা তিব্বতে ফেরেন এবং কুইংয়ের রাজপ্রতিনিধি আমবান ও সব চীনা সেনা বহিষ্কার করেন। ১৯১৩ সালে দালাই লামা এ মর্মে ফরমান জারি করেন যে চীন ও তিব্বত কেউ কারও অধীন নয়। পরবর্তী ৩৬ বছর তিব্বত মূলত স্বাধীন দেশ হিসেবে বিরাজ করে, যদিও ১৯৩০ সালে চীন তিব্বতের ওপর দাবি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। ১৯১৩ সালের তিব্বত-মঙ্গোলিয়া চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে তিব্বতের স্বাধীনতার আর এক স্বীকৃতি। ১৯১৪ সালে তিব্বত সরকার ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার ফলে ব্রিটিশ-ভারত ও তিব্বতের সীমানা বিভক্তির জন্য ম্যাকমেহন লাইন টানা হয়। সে চুক্তিতে চীন সাক্ষী হিসেবে দস্তখত করেছিল, যা মোটামুটি তিব্বতের স্বাধীনতায় চীনা স্বীকৃতি। যদিও পরবর্তীতে চীনা বিপ্লবের পর চীন সিমলা চুক্তি ও ম্যাকমেহন লাইন অস্বীকার করে। ১৯৫০ সালে চীন তিব্বত দখল করে মূলত তার নগ্ন আগ্রাসন প্রমাণ করেছে। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের জনগণ চীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পর চীন তিব্বতিদের ওপর চরম নির্যাতন শুরু করে, এমনকি তাদের ফসল নষ্ট করে সেখানে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। চীন শুধু তিব্বতের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপরই খড়্গ চালায়নি, তিব্বতের শস্য হস্তগত করে, যার ফলে তিব্বতে তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দেয়।

 

চীন কর্তৃক জিনজিয়াং দখলের ইতিহাস অনেক মর্মান্তিক, অমানবিক, বেদনাদায়ক এবং পাশবিক, যার নজির পৃথিবীতে বিরল। ১৮৮৪ সালে চীনের কুইং রাজা তুর্কি (আর্য) বংশীয় মুসলমান লোকদের আবাসভূমি দখল করেন, যার নাম ছিল জুনগারিয়া এবং টিয়ানশান। ১৮৬২ সালে সেই তুর্কি মুসলিম জনগোষ্ঠীর দ্বারা ডানগান বিদ্রোহের পর চীনা কর্তৃপক্ষ একে জিনজিয়াং নামে অধিষ্ঠিত করেন। অষ্টম শতকে তুর্কি বংশোদ্ভূত উইঘুর সম্প্রদায় সেখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম ধর্ম ছড়িয়ে দেয়। ১৩ শতকে এলাকাটি মোঙ্গল শাসনে ছিল। কিন্তু পরে আবার তুরস্ক বংশীয়রা ক্ষমতা নেয়। ৭৪৪ সালে উইঘুরের সম্প্রদায়ের নয়টি উপসম্প্রদায় মিলিতভাবে একটি কনফেডারেশন গঠন করে। ৮০৮ সালে উইঘুররা তিব্বতের কিছু এলাকা দখলে নেয়। ১২০৬ সালে চেঙ্গিস খান মোঙ্গল এবং তুর্কি উপজাতিদের একত্রিত করে মোঙ্গল সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেন। ১২০৯ সালে টারকান নামক উইঘুর অঞ্চল মোঙ্গলদের বশ্যতা মেনে নিলে উইঘুর নেতাদের তাদের এলাকার নিয়ন্ত্রণ প্রদান করা হয়। ১২১৮ সালে চেঙ্গিস খান ‘কোয়ারা খিটাল’ নামক উইঘুর শাসনাধীন এলাকা দখল করেন। ১২৭১ সালে চেঙ্গিস বংশধর কুবলাই খান চীনা অঞ্চলে ইউয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও অরিম এলাকার নিয়ন্ত্রণ মোঙ্গল রাজা ‘আরিক বোকের’ কাছে চলে যায়। ১৩৮৯ সালে খান মনসুর চাকতাই এবং তুঘলুগ তিমুর উইঘুর এলাকার বৌদ্ধধর্মাবলম্বী জনগণকে ইসলাম ধর্মে রূপান্তরিত করেন। ক্রমান্বয়ে এলাকাটি তুর্কি ভূমির মর্যাদা লাভ করে, যার নাম হয় ‘মুঘলিস্তান’। এভাবে ১০০ বছর রাজত্বের পর এলাকাটি দুই ভাগে ভাগ হয়, যার মধ্যে ইয়াকান্দ এলাকার রাজত্ব নেন মির্জা আবু বকর। উইঘুুর বংশীয় জুনগার শাসকদের সময় চীনের মহাপ্রাচীর এলাকা থেকে পূর্ব কাজাখস্তান পর্যন্ত এবং উত্তর কাজাখস্তান থেকে দক্ষিণ সাইবেরিয়া পর্যন্ত উইঘুর শাসন বিস্তৃত ছিল। ১৭৬০ সালে চীনের কুইং রাজবংশের শাসক কুইয়ান লং চূড়ান্তভাবে জুনগারিয়ান মালভূমি এবং তারিম বেসিন দখল করে জিনজিয়াং অঞ্চলভুক্ত করেন, যার দক্ষিণ অংশ ছিল তুর্কি বংশীয় মুসলমানদের বাসভূমি। ১৭৫৫ সালে কুইং মাঞ্চু শাসক জুনগারদের রাজ্য দখল করে সেখানে গণহত্যা চালান। এ সময় তুর্কি বংশীয় মুসলমানরা তখন চীনের কুইং শাসকদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হন। ১৭৬৫ সালে এক উইঘুর মহিলাকে চীনের কর্মকর্তারা গণধর্ষণ করলে উইঘুরের মুসলমানরা বিদ্রোহ করেন। তখন চীনের মাঞ্চু সম্রাট উইঘুরের বিদ্রোহ এলাকায় গণহত্যা চালানোর নির্দেশ প্রদান করেন, সব উইঘুর শিশু ও মহিলাকে ক্রীতদাসে পরিণত করেন এবং উইঘুর পুরুষদের হত্যা করেন। চীনা সেনারা উইঘুর নারীদের গণধর্ষণ করলে উইঘুর সম্প্রদায় চীনা শাসনের বিরুদ্ধে খেপে ওঠে। কিন্তু চীনা সম্রাটের নির্দেশে উইঘুর বিদ্রোহের নেতাদের দেহ খণ্ড খণ্ড করে হত্যা করা হয়। এরূপ নির্মমতার সঙ্গে সে সময়ের চীনা সম্রাট তুর্কী বংশীয় উইঘুরদের বিশাল খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকা সামরিকবলে দখলে নেয়। পরবর্তীতে চীনে প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক সরকারও একইভাবে নির্যাতন চালাতে শুরু করে উইঘুরদের ওপর, যা এখন চলছে। ১৯৫৫ সালে অঞ্চলটিকে স্বায়ত্তশাসিত এলাকার মর্যাদা দেওয়া হয় বটে, কিন্তু সেটি নামমাত্র। চীন জিনজিয়ান প্রদেশকে স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা তো দেয়ইনি বরং সেখানে তুর্কি বংশীয় মুসলমানদের ওপর চালাচ্ছে গণহত্যাসহ অকথ্য নির্যাতন, সেই কুইং রাজাদের মতো। জিনজিয়ানে মুসলিম নারীদের ওপর অবাধ ধর্ষণ চালাচ্ছে চীনা সেনা, আইন প্রয়োগকারী এবং কর্মকর্তারা, যার জন্য বিশ্বের অনেক দেশই সোচ্চার হলেও পাকিস্তান, এমনকি তুরস্ক উইঘুর মুসলমানরা যাদের জাতভাই, তারাও নিশ্চুপ, চীনের টাকার বস্তার দিকে তাকিয়ে।

 

চীন যে ভূমি দখলের ব্যাপারে তার অতিঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও ছাড় দেয় না তার প্রমাণ পাকিস্তানে গোয়াদর উপকূলে পাকিস্তানি দ্বীপ দখল। চীন নেপালের ভূমি দখল করেছে বলে সম্প্রতি নেপাল সরকার অভিযোগ করেছে, অথচ নেপালের সঙ্গে চীন শুধু গভীর সখ্যই গড়েনি, নেপালে চীনা রাষ্ট্রদূত নির্লজ্জের মতো খোলাখুলিভাবে নেপালের রাজনীতি প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন, সফল হয়নি যদিও। সম্প্রতি চীন ভুটানের অভ্যন্তরেও প্রবেশ করেছে বলে ভুটান সরকার অভিযোগ করেছে। আর ভারতের ভূমিতে তো চীন প্রতিনিয়তই প্রবেশ করছে। আন্তর্জাতিক সমুদ্র কনভেনশনের বিধান ভঙ্গ করে দক্ষিণ সাগর, যা মহাসাগর বটে, সমুদ্র আইনের দৃষ্টিতে যা সব দেশের জন্য উন্মুক্ত, চীন সেই মহাসাগরকে নিজ দেশের একক সার্বভৌম অংশ দাবি করে বিশ্বযুদ্ধের পাঁয়তারা করছে, যার জন্য অস্ট্রেলিয়াসহ এ অঞ্চলের অন্য দেশ যথা জাপান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই প্রভৃতি দেশের সঙ্গে চীনের অনেকটাই যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, যার জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনা এবং কোয়াড মোর্চা গড়ে উঠেছে। আমাদের সৌভাগ্য চীনের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত নেই। থাকলে চীন আমাদের ভূমিও দখল করত। চীন একই নীলনকশা নিয়ে সিরিয়ায় অনুপ্রবেশের চেষ্টায় লিপ্ত বলে খবর পাওয়া গেছে।

 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় শুধু চীনের ঋণ দেওয়ার টাকার বস্তার কথাই বলেছেন, চীনের ঘুষের টাকার বস্তার কথা বলেননি। চীন যে আর একটি টাকার বস্তা রেখেছে বাংলাদেশে ঘুষবাণিজ্য প্রসারিত করার জন্য তা প্রমাণিত সত্য। কয়েক বছর আগে এক সিনিয়র সচিবকে মোটা অঙ্কের ঘুষ প্রদানের চেষ্টা করলে সেই দেশপ্রেমী সচিব সাহেব তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে জানিয়ে দিলে ঘুষ প্রদানকারী কোম্পানির একটি প্রজেক্ট বাদ করা হয়। চীন টাকা ছড়াচ্ছে বাংলাদেশে। যার কারণে তাদের পক্ষে কথা বলার লোকের অভাব নেই। এদের অনেকে আবার মজ্জাগত ভারতবিরোধী বিধায় চীনের প্রতি তাদের বন্দনা অপরিসীম শুধু ভারতবিরোধিতার কারণে। তাদের বদলানো কষ্টকর। কারণ তারা হয় চীনা টাকায় বুঁদ হয়ে আছে অথবা মজ্জাগত ভারতবিরোধী। চীন মহেশখালীর পাশে একটি দ্বীপকে তথাকথিত উন্নয়নের প্রস্তাব দিয়েছে এই শর্তে যে, দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই থাকবে, অর্থাৎ তারা এটিকে বাংলাদেশের হাম্বানটোটায় পরিণত করে এটি তাদের দখলে নেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সম্প্রতি প্রজ্ঞাবান, কর্তব্যনিষ্ঠ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, গভীর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, জাতির বিবেক বলে স্বীকৃত গাফ্ফার ভাই এবং নির্ভয়ে সত্য, মেধা ও গবেষণা-ভিত্তিক, বস্তুনিষ্ঠ এবং জাতির জন্য মঙ্গলকর লেখার জন্য জনপ্রিয়তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সৈয়দ বোরহান কবীর তাঁদের সুচিন্তিত এবং গবেষণামূলক শক্ত লেখনী দ্বারা চীনের কুমতলবের কথা রাখঢাক না রেখেই ব্যক্ত করেছেন, যা দেখে দেশের মানুষ নিশ্চয়ই এর প্রতিবাদে সোচ্চার হলে, চীনের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা। আজ সদ্যপ্রয়াত পীর হাবিবুর রহমানের অনুপস্থিতি খুব অনুভব করছি, কারণ তাঁর ক্ষুরধার লেখনীও চীনের মতলব এবং বাংলাদেশে বসবাসরত সে দেশের পোষ্যদের চক্রান্ত উন্মোচনে সহায়ক হতো। তবে দেশের অন্য বহু বরেণ্য এবং মেধাসম্পন্ন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তিমান লেখকরাও এ বিষয়ে তাঁদের কালি-কলম ব্যবহার করলে চীনা কুকীর্তির পরিকল্পনা অবশ্যই ভেস্তে যাবে।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com